বাংলাদেশে বর্ষা - প্রবন্ধ রচনা একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি

গ্রীষ্মের প্রচণ্ড উত্তাপে যখন খাল-বিল, নদী, ফসলের খেত ফেটে চৌচির আর অসহ্য গরমে অস্থির মানুষ যখন ব্যাকুল হয়ে ওঠে দু'ফোঁটা জলের জন্যে, তখন ধূলিধূসর রুক্ষতার মালিন্য মুছিয়ে দিতে স্নিগ্ধতার ডালি নিয়ে আসে বর্ষা। বনে বনে লাগে নতুন প্রাণের শিহরন। বৃষ্টির ধারায় ধরণি সজল, সজীব, সরস ও সুন্দর হয়ে ওঠে।

 

বাংলাদেশে বর্ষা

বাংলাদেশে বর্ষা

গ্রীষ্মের প্রচণ্ড উত্তাপে যখন খাল-বিল, নদী, ফসলের খেত ফেটে চৌচির আর অসহ্য গরমে অস্থির মানুষ যখন ব্যাকুল হয়ে ওঠে দু'ফোঁটা জলের জন্যে, তখন ধূলিধূসর রুক্ষতার মালিন্য মুছিয়ে দিতে স্নিগ্ধতার ডালি নিয়ে আসে বর্ষা। বনে বনে লাগে নতুন প্রাণের শিহরন। বৃষ্টির ধারায় ধরণি সজল, সজীব, সরস ও সুন্দর হয়ে ওঠে।

মহাকবি কালিদাস মেঘের আবির্ভাব দেখেছিলেন ‘আষাঢ়স্য প্রথম দিবসে'। ষড়ঋতুর হিসেবে বর্ষাকাল মূলত আষাঢ় ও শ্রাবণ এই দুমাস নিয়েই। কিন্তু বাংলাদেশে বর্ষা কখনোই এই দুমাসে সীমাবদ্ধ থাকে না। ঠিক কোন দিনটিতে যে বর্ষা এল কিংবা কবেই-বা চলে গেল এর সঠিক হিসেব টানা যায় না। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ থেকে আশ্বিনের মাঝামাঝি পর্যন্ত এর পরিধি। তবে আষাঢ় আর শ্রাবণেই বর্ষাকে পরিপূর্ণভাবে দেখা যায়।

বর্ষায় বাংলা অপরূপ রূপ নেয়। ধূলিমলিন বিবর্ণ প্রকৃতিতে প্রাণের হিল্লোল জাগে। বর্ষাকালে প্রায়ই আকাশ থাকে ধূসর কিংবা কালো মেঘে ঢাকা। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকায় আর মেঘের গুরু গুরু গর্জনে আমাদের হৃদয়ও আঁতকে ওঠে। গাছের ডালে পাতায় পাতায় লাগে উতল হাওয়ার মাতম। অবিরাম বর্ষণে নদী-নালা, খাল-বিল জলে টইটম্বুর করে। কবি রবীন্দ্রনাথ ‘আষাঢ়’ কবিতায় বর্ষার ছবি এঁকেছেন এভাবে—

নীল নবঘনে আষাঢ়গগনে তিল ঠাঁই আর নাহিরে।

ওগো, আজ তোরা যাসনে ঘরের বাহিরে

বাদলের ধারা ঝরে ঝরো ঝরো, আউষের ক্ষেত জলে ভরো-ভরো,

কালিমাখা মেঘে ওপারে আঁধার ঘনায়েছে দেখ চাহিরে—


বর্ষার প্রকৃতি সারাদিন অবিরত কেঁদেই চলে। যে নীলাকাশ উদারতার প্রতীক সেও আজ বিষণ্ন। কবি তাই বলেছেন, ‘আজিকে বাহিরে শুধু ক্রন্দন ছলছল জলধারে।' অন্যদিকে মাটিতে তখন আনন্দের শিহরন। বৃষ্টির পরশ পেয়ে সমস্ত প্রকৃতি সরস, সজীব ও শ্যামল। আষাঢ় আর শ্রাবণে এক-এক সময় দিনের পর দিন বর্ষণ চলতে থাকে। অনেকদিন সূর্যের চেহারা পর্যন্ত চোখে পড়ে না। গ্রীষ্মের প্রচন্ড প্রতাপশালী সূর্য ঘুমিয়ে পড়ে কালো মেঘের আড়ালে। আকাশ ভেঙে নামে অঝোর বৃষ্টি। বৃষ্টির ঝাপসা আচ্ছাদনে আচ্ছন্ন হয়ে যায় চারিদিক। দূর বনানীর গা ঘেঁষে সন্ধ্যার অনেক আগেই জমাট অন্ধকার নেমে আসে। আর বৃষ্টির জলে মাঠ-ঘাট থই থই করে। চারিদিকে কেবল পানি আর পানি। মাঝখানে ছোট ছোট গ্রাম দ্বীপের মতো ভাসে। নৌকা ছাড়া যাতায়াতের কোনো উপায় থাকে না। বর্ষার প্রতীক কদমফুলে ছেয়ে যায় গাছ। কেয়া বনে চলে ফুল ফোটার প্রতিযোগিতা। সব মিলিয়ে এ যেন এক মোহনীয় পরিবেশ। প্রকৃতি কেবল সেজেই চলেছে।

বর্ষার ক্লান্তিহীন বর্ষণ, বজ্রপাত কিংবা উতলা বাতাসের মধ্যেও চাষি মাথাল মাথায় দিয়ে হাল চাষ করে, মাঠে বীজ বোনে, রোপণ করে চারাগাছ। কৃষকের চোখে থাকে অনাগত দিনের শস্যশ্যামল মাঠের স্বপ্ন। বর্ষার পানি না পেলে ফসলের আশা কম। তাই বর্ষা কৃষিপ্রাণ বাংলার বুকে আশা—ফসলের প্রতিশ্রুতি। বর্ষার বারিধারা ও জলস্রোত বাংলাদেশের মাটিতে নিয়ে আসে পলিমাটি আর সেই পলিমাটিই জমিকে করে তোলে উর্বরা, সোনাফলা। কিন্তু দিনের পর দিন অঝোর বৃষ্টির কারণে মাঝে মাঝে খেতের কাজ বন্ধ থাকে। তখন চাষিরা গ্রামের বৈঠকখানায় জড়ো হয়। তখন তাদের কিছুটা অবসর যাপনের কাল। সন্ধ্যার পর জমে ওঠে গান কিংবা গল্পের আসর। পল্লিকবি জসীম উদ্দীন এ চিত্রই এঁকেছেন—

গাঁয়ের চাষিরা মিলিয়াছে আসি মোড়লের দলিজায়,

গল্পে গানে কি জাগাইতে চাহে আজিকার দিনটায়!

মোড়লের বৈঠকখানায় গল্পের পাশাপাশি চলে হাতের কাজ। কেউ রশি বানায়, কেউ বা নিখুঁত ফুল বানায় বাঁশের লাঠিতে। গায়েন বানায় সারিন্দা। পাশাপাশি ডাব্বা হুঁকাও ঘুরে বেড়ায় এক হাত থেকে অন্য হাতে। দিকে অন্দরমহলে চলে শিকা বানানো কিংবা নকশি কাঁথা তৈরির কাজ। অঝোর বাদলে পাড়ার বৌ-ঝিদের আর এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি যাবার জো নেই। একদিকে হাত চলে আর মন চলে যায় সুদূর অতীতে। শৈশবে বাপের বাড়িতে কাটানো বর্ষার স্মৃতি হয়তো তার চোখে ধরা দেয় নিবিড় আবেশে। অনেক সময় অতিবর্ষণের ফলে বর্ষাকালে মারাত্মক সংকট সৃষ্টি হয়। কোনো কোনো অঞ্চল বন্যায় ভেসে যায়। ফসল, ঘর-বাড়ি, জনপদ অনেক সময় ধ্বংস ও নিশ্চিহ্ন হয়। যাতায়াতের পথ হয়ে ওঠে দুর্গম। প্রাণহানিও ঘটে।

শহুরে জীবনে বর্ষা খানিকটা দুঃসহ। পানি নিষ্কাশনের সুষ্ঠু ব্যবস্থা না থাকায় শহরের রাস্তায় জল জমে জলাবদ্ধতা তৈরি করে। বিপর্যস্ত হয় স্বাভাবিক জনজীবন আর নোংরা পানির কারণে পরিবেশ অস্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে। বিশেষ করে বস্তিবাসী আর ছিন্নমূল মানুষের দুর্দশার অন্ত থাকে না। নিঃস্ব আর দরিদ্র পল্লিবাসী এবং শহরের বস্তিবাসীর ভাঙা ঘরে আর ফাঁকা ভিটেতে সংকট বাড়ে। এ সময় নানারকম পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ম্যালেরিয়া, টাইফয়েড, ইনফ্লুয়েঞ্জা, আমাশয়, কলেরা, জন্ডিস প্রভৃতি সংক্রামক রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ।

বর্ষা কবির মনে জাগিয়ে তোলে নতুন ভাব। বর্ষায় নিত্যনতুন ভাবরসে সিক্ত হয় মানুষের মন। প্রাচীন কবি জয়দেব থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক সময়ে কবি-সাহিত্যিকরা বিচিত্রভাবে বর্ষাকে এঁকেছেন কাব্যে-সাহিত্যে। বৈষ্ণব কবি বর্ষণমুখর অন্ধকারে রাধিকার অভিসার চিত্র অঙ্কন করেছেন। বর্ষার দুঃখের ছবি এঁকেছেন মঙ্গলকাব্যের কবিরা। কবি কালিদাস বর্ষায় প্রত্যক্ষ করেছেন অনন্ত বিরহ। বর্ষার নির্জনতা, নিঃসঙ্গতার শান্ত বেদনাভারাতুর ভাব-পরিবেশ কবিকে আচ্ছন্ন করেছে। বারিধারার বিষাদকরুণ সুর তাঁকে আপ্লুত ও অভিভূত করেছে। কবি গেয়েছেন—

হৃদয়ে আজ ঢেউ দিয়েছে, খুঁজে না পাই কূল

সৌরভে প্রাণ কাঁদিয়ে তোলে ভিজে বনের ফুল।

আঁধার রাতে প্রহরগুলি কোন্ সুরে আজ ভরিয়ে তুলি,

কোন্ ভুলে আজ সকল ভুলি আছি আকুল হয়ে ।


কৃষিপ্রধান বাংলাদেশে বর্ষা এক প্রয়োজনীয় ঋতু। ভাবুকের চিত্তেও বর্ষার ব্যঞ্জনা অপরিসীম। এ ঋতু অপকারের চেয়ে উপকারই করে বেশি। বর্ষা না এলে মরুভূমি হয়ে যেত এ শস্যশ্যামল দেশ। তাই বর্ষার সাথে আমাদের প্রাণের সম্পর্ক। বর্ষাকে বিদায় জানাতে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন,

কালো মেঘের আর কি আছে দিন।

ও যে হলো সাথীহীন।

পুব হাওয়া কয় কালোর এবার যাওয়াই ভালো

শরৎ বলে গেঁথে দেব কালোয় আলো।

প্রকৃতির নিয়মে আবার ঘুরে ফিরে আসে বর্ষা তার স্নিগ্ধ রূপের ডালি নিয়ে সাজাতে এ বাংলাকে।


( অনুরূপ রচনা : আমাদের জীবনে বর্ষা, আমার প্রিয় ঋতু বর্ষা, বাংলার বর্ষা, বর্ষায় বাংলাদেশ )

আর্টিকেলের শেষকথাঃ   বাংলাদেশে বর্ষা - প্রবন্ধ রচনা 

শিক্ষার্থীরা  আজকে আমরা জানলাম  বাংলাদেশে বর্ষা - প্রবন্ধ রচনা সম্পর্কে  । যদি আজকের এই  বাংলাদেশে বর্ষা - প্রবন্ধ রচনা টি ভালো লাগে তাহলে এখনি ফেসবুকে বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করুন আর এই রকমই নিত্যনতুন আর্টিকেল পেতে আমাদের সাথেই থাকুন ধন্যবাদ । Search-Asked BD


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url