বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য - প্রবন্ধ রচনা একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি

 বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য  (দি. বো. ২০১৬) বাংলাদেশের নিসর্গে ষড়ঋতুর প্রভাব (য. বো. ২০০০) বাংলাদেশের ষড়ঋত (ঢা. বো. ২০০৭) ষড়ঋতুর বাংলাদেশ (ঢা. বো. ২০১৪

বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য

বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য  (দিবো২০১৬)
বাংলাদেশের নিসর্গে ষড়ঋতুর প্রভাব (বো২০০০)
বাংলাদেশের ষড়ঋত (ঢাবো২০০৭)
ষড়ঋতুর বাংলাদেশ (ঢাবো২০১৪)

আবহাওয়াবিদদের মতে পৃথিবীতে প্রধান ঋতু চারটি গ্রীষ্ম, হেমন্ত, শীত বসন্ত। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশে
বছরে ছয়টি ঋতুর আবর্তন হয়, সেই সাথে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ধারণ করে বিচিত্র রূপ। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত বসন্ত এই ছয় ঋতুর আবর্তনে আমাদের বছর কেটে যায়। এদের কোনোটিই হঠাৎ এসে হাজির হয় না।
বাংলাদেশের বিচিত্র ঋতু পরিক্রমা মাসের সীমারেখাও মেনে চলে না। তবু প্রতি দুমাসকে একটি ঋতু হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। সেদিক থেকে বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ হলো গ্রীষ্মকাল, আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষাকাল, ভাদ্র-আশ্বিন শরৎকাল, কার্তিক- অগ্রহায়ণ হেমন্তকাল, পৌষ-মাঘ শীতকাল আর ফাল্গুন-চৈত্র হচ্ছে বসন্তকাল। একেক ঋতুর একেক রূপ একাকার হয়ে যায় আরেকটি রূপের সাথে। তবু একসময় আমরা অনুভব করি প্রকৃতির একটা রূপ পেরিয়ে অন্য একটা রূপের মধ্যে এসে পড়েছি


বছরের শুরুতে বাংলার প্রকৃতিতে আবির্ভাব হয় গ্রীষ্ম ঋতুর। বাংলার জীবনে বৈশাখ আসে নতুনের বার্তা নিয়ে। বৈশাখ নতুন বছরের সূচনার দিন, হালখাতার দিন। কিন্তু তাই বলে ঋতু হিসেবে বৈশাখ তেমন সুখকর নয়। কারণ, গ্রীষ্মের আগমনে বাংলার প্রকৃতি রুক্ষ, বিবর্ণ বিশুষ্ক হয়ে ওঠে। প্রচণ্ড তাপে আকাশ-মাটি যেন পুড়ে খাক হয়ে আসে। হারিয়ে যায় সবুজ প্রকৃতির অপরূপ শ্যামল শোভা। ফেটে চৌচির হয় ফসলের মাঠ, শুকনো নদী। চারিদিকে কেবল ধু- ধু হাহাকার। ভয়াল রুদ্র রূপ নিয়ে ধুলোর ঝড় তুলে আসে মত্ত কালবৈশাখী। তার প্রচণ্ড ঝাপটায় ছারখার করে দেয় চারিদিক। প্রকৃতিকে নতুন করে সাজাতেই যেন সে ভেঙে চুরমার করে দেয় সবকিছু। বাতাসে আগুনের হলকায় প্রাণ আইঢাই করে ওঠে। ঊর্ধ্ব আকাশে চাতকের মতো দৃষ্টি কৃষকের কখন একটু বৃষ্টি নামবে। একটুখানি পানি, একটু ঠান্ডা বাতাস আর গাছের শীতল ছায়া পেলে প্রাণ যেন জুড়িয়ে যায়। রুক্ষতা কঠোরতার মধ্যেও প্রকৃতি ডালি ভরে সাজিয়ে দেয় বিচিত্র সব ফল। এই বৈশাখকেই কবি রবীন্দ্রনাথ সম্বোধন করেছেন 'মৌনী তাপস' বলে।


বজ্রের কাড়া-নাকাড়। বাজিয়ে, বিদ্যুতের পতাকা উঁচিয়ে বর্ষা আসে দিগ্বিজয়ী যোদ্ধার মতো। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড রুক্ষতার পর সজল কালো মেঘময় দিনের ছায়া নামে বাংলার প্রকৃতিতে। বর্ষা প্রকৃতির চেনা রূপ একেবারে পালটে দেয়। বৃষ্টির অঝোর ধারায় গাছে গাছে, পাতায় পাতায় লাগে শিহরন, জাগে সজীবতা। বর্ষার মিষ্টি ছোঁয়ায় কেয়াফুল ঘোমটা খুলে পাপড়ি মেলে, মাতাল গন্ধে আকুল করে চারপাশ। কদম ফুলের পেলব কোমল শরীরের স্পর্শ নিতে ছুটে আসে বাদল দিনের ঝড়ো হাওয়া। কালো মেঘের দল চোখের পলকে পলকে হানে বিদ্যুৎ-বাণ। আর আকাশ-বাতাস-মাটিতে অঝোর ধারায় বৃষ্টি ঝরে রিমঝিম রিমঝিম রিমঝিম। বর্ষা কৃষকের জীবনে নিয়ে আসে মহা আশঙ্কাও সেটা বন্যার, ধ্বংসের, ফসলহানির। বাংলার কবিদের কাছে বর্ষা স্মৃতি জাগানিয়া ঋতু। বর্ষাকে নিয়ে কবিতা রচনা করেননি এমন কবি বোধ হয় বাংলাদেশে নেই।


আষাঢ়-শ্রাবণের অবিরাম বর্ষণের পরও বর্ষা শেষ হয় না। বাংলাদেশে ভাদ্র ছাড়িয়ে আশ্বিনের আঙিনাতেও মাঝে মাঝে বর্ষা দুরন্ত মেয়ের মতো হঠাৎ করে সবকিছু ভিজিয়ে দেয়। তাই তো শরতের প্রথম দিকে চলে মেঘ বৃষ্টি আর আলোর মধ্যে লুকোচুরি খেলা। এই খেলা খেলতে খেলতেই বর্ষার কালো মেঘের দল কোথায় যেন একেবারে লুকিয়ে যায খুঁজে পাওয়া যায় না। বর্ষা-বিধৌত প্রকৃতি হয়ে ওঠে 'শুভ্র যেন সে নবনী' নীল আকাশে ভেসে চলে সাদা মেঘের ভেলা আর বাতাস জুড়ে থাকে কদম, কেয়া, শিউলির মৃদু গন্ধ। নদীতীরে কাশফুল শুভ্র হাসি ছড়িয়ে দেয় দিগন্তে। গ্রীষ্মদদ্ধ আর বর্ষামন্থর প্রকৃতিতে শরৎ নিয়ে আসে সৌন্দর্যের অপরূপ মহিমা। শরৎ কেবল আলোর মেলাই বসায় না, কৃষিনির্ভর দেশের জনগণের জীবনে জাগায় আনন্দের সাড়া। কেননা, যে ফসল বর্ষায় বৃদ্ধি পায় শরতে শোনা যায় তার আগমনী বার্তা। কবিগুরু গেয়েছেন
শরত্বাণীর বীণা বাজে কদমতলে
ললিতরাগের সুর ঝরে তাই শিউলিতলে
তাই তো বাতাস বেড়ায় মেতে কচিধানের সবুজ ক্ষেতে,
বনের প্রাণে মরমরানি ঢেউ উঠালে।


ফসল ফলাবার নিরলস সাধনায় মগ্ন হেমন্ত আসে চুপিসারে, নীরবে। শ্বেতশুভ্র পুঞ্জ মেঘের নাচে শিউলি ফুলের নকশা করা অঙ্গনে শরতের আনন্দমেলা যখন শেষ হয়ে আসে তখন ঋতুমঞ্চে সবার অলক্ষে কুয়াশার মতো পাতলা পর্দা টেনে দেয় প্রকৃতি। আনন্দমেলা শেষে রিক্ত নির্জনপ্রায় রঙ্গমঞ্চে নীরবে নিঃশব্দে আগমন হয় হেমন্তের। হেমন্ত শরতের পরিণতি আর শীতের পথপ্রদর্শক। হেমন্তের বর্ণ ধূসর; কিন্তু সে ধূসরতায় রিক্ততা নেই, আছে পরিপূর্ণতার
এক আমেজ। হেমন্তে ধান পাকে। পাকা ধানের গন্ধে ভরে ওঠে গ্রামবাংলা। ঘরে ঘরে চলে ফসল তোলার নবান্ন' উৎসব। চিরায়ত কাল ধরে হেমন্তই দেশের মাটির সন্তানদের হাতে তুলে দিয়েছে শস্য সম্পদ, কল্যাণদাত্রী জননীর মতো। তবু নিজের দানের আড়ালে চিরকাল নিজেকে গুটিয়ে রাখে সে। কুয়াশার আবছা পর্দার আড়ালে হেমন্ত বিষণ্নতার প্রতিমূর্তি। কবিগুরুর গানে হেমন্ত ধরা দিয়েছে এভাবে

ধরার আঁচল ভরিয়ে দিলে প্রচুর সোনার ধানে।
দিগাঙ্গনার অঙ্গন আজ পূর্ণ তোমার দানে।
আপন দানের আড়ালেতে রইলে কেন আসন পেতে,
আপনাকে এই কেমন তোমার গোপন করে রাখা।


অগ্রহায়ণ শেষ হতে না হতেই উত্তরের বাতাসে শীত নামে বাংলার ঘরে। ভোরের ঘন কুয়াশার আবরণের অন্তরালে প্রকৃতি তার সমস্ত রূপসজ্জার অলংকার ছুঁড়ে ফেলে রিক্ত বৈরাগীর রূপ নেয়। গাছপালা সজীবতা হারায়। শুরু হয় পাতা ঝরার পালা। অন্যদিকে বিবিধ শাকসব্জি আর রঙ-বেরঙের ফুলের শোভায় প্রকৃতির মালঞ ভরে ওঠে। নতুন ফসল, অঢেল শাকসব্জি আর খেজুরের রস পেয়ে বাঙালি মেতে ওঠে পৌষ পার্বণের উৎসবে। তবে দরিদ্র জনগোষ্ঠী প্রচণ্ড শীতে সীমাহীন কষ্ট ভোগ করে।

শিশিরসিক্ত যেসব জীর্ণ পাতা পড়ি পড়ি করেও ঝরে পড়েনি হঠাৎ একদিন দখিনা পবনে সেসব যায় ঝরে। আর সেই দখিনা বাতাসের সাথেই বিদায় নেয় শীত। আসে বসন্ত। ঋতুরাজ বসন্তের অভিষেক সম্পন্ন করে আমের মুকুল। দেখতে না দেখতে প্রকৃতিতে দারুণ চাঞ্চল্য জাগে। গাছে গাছে কোথা থেকে আবার ফিরে আসে পাখিরা। কলকাকলিতে তারা মুখর হয়ে ওঠে। গাছের শূন্য শাখা-প্রশাখায় নতুন সবুজ কিশলয় বিকশিত হতে থাকে। অশোক, পলাশ, কৃষ্ণচূড়া আর শিমুলের গাছে যেন লাল ফুলের আগুন লাগে।


ফাগুনের ফুলের খেলা শেষ হতে না হতেই আসে চৈতালি মুহূর্ত। পঞ্জিকার পাতায় এও কিন্তু বসন্তকাল। কিন্তু
চৈত্রের দুপুরে যেন সব চুপচাপ। আকাশ বাতাস নিথর। কোথায় যেন উদাসী ঘুঘু কাঁদে। কোকিলের ডাকে যে বসন্তের সূচনা হয়েছিল ঘুঘুর কান্নায় তার ভাঙার খেলা শুরু হয়। একসময় এই নীরবতার অবসান ঘটায় চৈতালি ঝড়। পাতা ফুল সব উড়িয়ে নেয়। বুঝতে পারা যায়, গ্রীষ্ম আসছে। পুরাতন বছরকে বিদায় দিয়ে নতুনকে বরণের জন্যে তৈরি
হতে হয়। বাজে বিদায় সংগীত-

চলে যায় মরি হায় বসন্তের দিন।
দূর শাখে পিক ডাকে বিরামহীন।
অধীর সমীর ভরে উচ্ছ্বসি বকুল ঝরে,
গন্ধ-সনে হল মন সুদূরে বিলীন।

এই হলো বাংলার বিভিন্ন ঋতুর আবর্তনের সংক্ষিপ্ত পরিচয়। রুদ্র গ্রীষ্ম, শ্যামস্নিগ্ধ বর্ষা, প্রসন্ন শরৎ, বিষণ্ন হেমন্ত, রিক্ত শীত এবং ঐশ্বর্যময়ী বসন্ত একের পর এক এসে তাদের সৌন্দর্য বৈচিত্র্যে কানায় কানায় ভরিয়ে তোলে বাংলার প্রকৃতিকে। এর প্রভাব পড়ে বাঙালির হৃদয়-মনে। কিন্তু এদের মধ্যে বর্ষার শ্যামশ্রীতে এবং শরতের শুভ্র মেঘখচিত শারদ লাবণ্যে বাংলার প্রকৃতি বিশিষ্ট অনন্য।

( অনুরূপ রচনা : রূপসি বাংলার ঋতুরঙ্গ, ষড়ঋতুর বাংলাদেশ, বাংলাদেশের ষড়ঋতু )

আর্টিকেলের শেষকথাঃ   বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য - প্রবন্ধ রচনা 

শিক্ষার্থীরা  আজকে আমরা জানলাম  বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য - প্রবন্ধ রচনা সম্পর্কে  । যদি আজকের এই  বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য - প্রবন্ধ রচনা টি ভালো লাগে তাহলে এখনি ফেসবুকে বন্ধুদের মাঝে শেয়ার করুন আর এই রকমই নিত্যনতুন আর্টিকেল পেতে আমাদের সাথেই থাকুন ধন্যবাদ । Search-Asked BD


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url